মাদরাসা পর্ব – ১
শুরুটা হয়েছিল স্কুল দিয়ে।ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত!
বাবা মা আর নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতেই স্বপ্নের শহরের উদ্দেশ্যে বের হই।লোকে মুখে কত কি গল্প।ইয়া বড় বড় দালান কোঠা আর খুব সুন্দর শহর নাকি!
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত প্রতি পরীক্ষাতেই হয়তো একটা ট্রান্সলেশন ছিল Dhaka is the capital of Bangladesh । একটা জিনিস যেটা পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে সেটাকে যখন বাস্তবে কিংবা প্র্যাক্টিক্যালি সেই গন্ডিতে প্রবেশ করা যায় ব্যাপারটা তুলনামূলক ভিন্নভাবে আবির্ভূত হয়। ইয়া বড় বড় দালান কোটা! সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা! আরো কত কি!ইয়া বড় বড় গাড়ি কি সুন্দর গাড়ি রাস্তাঘাট!
মফস্বলে বেড়ে উঠা একজন কিশোর আমি!
ঢাকার আবহাওয়া টা সত্যিকার অর্থে উপযোগী নয়।আগে হয়তো আরেকটু ভাল ছিল কিন্তু ডে বাই ডে তা খারাপ ই হচ্ছে! ঢাকায় আসার পর তার বিরূপ আবহাওয়া আমার শরীরটাকে অনেকাংশে শেষ করে দেয়।যেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনেক পরে! এখনো সেই রেশ আছে কিছুটা!
সেদিন মাদ্রাসা নিয়ে একটি ভিডিও চোখে পড়তেই অজান্তেই চোখে পানি চলে এসেছিল।
যেদিন প্রথম হাফিজিয়া এতিমখানা মাদরাসায় ভর্তি হই।সেদিন পরণে ছিল প্রিয় নীল প্যান্ট (স্কুলের ফুল প্যান্ট) আর একটি প্রিয় লাল টাইপের টি শার্ট।
ভাইয়া সেদিন প্রথম নিয়ে যায়!
গিয়েই দেখি হুজুর একজন কে বেদম প্রহার করছেন!
আমাকে দেখে উনি সেটা থেকে বিরত থেকে ছাত্র কে বললেন চলে যেতে এখন!
পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হতে অনেক সময় লেগেছিল।বয়স তখন সাড়ে ৮ বা ৯ হবে! বাবা মা পরিবার ছাড়া! কান্নাকাটি করতাম! পালিয়েও গিয়েছিলাম ছুটির ঘন্টা বাজতেই! নতুন শহর! শত শত অলি গলি যেখানে আমি সম্পূর্ণই নতুন।সেটা যেমন তেমন কথা না এই শহরে! যে রাস্তার অলগলি সম্পূর্ণ অচেনা! চলে গিয়েছিলাম অনেক দূরে ভাইয়ার মেসে! আবার দিয়ে যাওয়া আবার চলে যেতাম! এর মাঝে কত শত কাহিনী!
মনে আছে একবার মা সুনামগঞ্জ থেকে এসেছিল আমাকে দেখতে! মা চলে যাচ্ছে দেখে আমি কিভাবে থাকি।রিকশার পেছন পেছন যাওয়া।এক সময় মাটিতে শুয়ে পড়েছিলাম রিকশা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে! মা ঠিক ই চলে গিয়েছিল। অলি গলির লোকজন আমাকে আবার ধরে এনে মাদরাসায় দিয়ে যায়!
খাবার খেতে যাবার সময় লাইন ধরে খাবার নেওয়া।তরকারির পরিমাণটুকু নাই বা বললাম! মায়ের হাতের খাবার আর এই খাবার শতজন্মের ব্যবধান! খেয়ে না খেয়ে শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল! তেমন কেউ ছিল না দেখবে বলে। তখনো মোবাইল আসেনি! ল্যান্ড ফোন চলে! ১৯৯৯/২০০০ এর কথা!
বাবাকে মা কে চিঠি লিখতাম! আর ভাইয়া সেগুলো না দিয়ে রেখে দিত ! বাবা আর মায়ের পাওয়া চিঠিগুলো খুব যত্ন করে রেখে দিতাম।২০১২ এর ২৯ মে পর্যন্ত তা আমার কাছে ছিল!
প্রতি রাতে পুঁইশাক ভাল লাগতোনা বলে ফেলে দিতাম খাবার! গাঁয়ে হাতে বিচি পাঁচড়ায় ভরে গিয়েছিল!
এমন অবস্থা হয়েছিল শোয়া থেকে সোজাসুজি উঠতে পারতাম না! আগে উপুড় হওয়া লাগতো! তারপর!না হলে পেটে প্রচুর ব্যথা হতো উঠার সময়! এমন ও হয়েছিল যে টানা ৩/৪ দিন টয়লেট ও হয়নি!
চলবে
ধীরে ধীরে ঠিক হই পরিবেশকে মানিয়ে নিই!
যারা মাদরাসায় পড়ে! বিশেষ করে হাফেজী মাদরাসা! তাদের লাইফটা অনেক ভিন্ন! আবদ্ধ তবে অবাধ্যতার কোনো সুযোগ নেই। রাত ৩টায় উঠে পড়া! সকাল ৯/৯ঃ৩০ পর্যন্ত! আবার ১২ টা থেকে আছর আবার মাগরিব থেকে রাত ৯টা!অনেক মাদরাসায় এমন ও আছে যে খেলা নিষেধ ছিল! পত্রিকা পড়া বারন ছিল! আছরের পর অবসর সময়টুকু ও চার দেয়ালের বাহিরে যাওয়া যাবে না! কতশত বিধি নিষেধ!আর পড়া না পারলে তো কত ধরনের শাস্তি! তবে এটা বলতে পারি যারা মাদরাসায় পড়ে কিংবা লাস্টিং করতে পেরেছে তারা তাদের লাইফে চলার পথে অনেক শিক্ষা ওখান থেকেই পেয়ে যায় যা পরবর্তিতে সহায়ক!
ফারুক হুজুরের বেতের বাড়ির দাগ গায়ে না থাকলেও মনের ভিতর আছে!
তাহের হুজুরের শুরুতে চকোলেট দেওয়া আর পরে তার বেতের বাড়ির কথাও মনে আছে!
এটাও মনে আছে তার মসজিদে সে আমাকে তারাবী দিয়েছিল! অন্য জায়গায় উর্ত্তীণ হবার পর ও দেয়নি সেখানে!
সেসব ভয় আমার এখনো কাজ করে! বড় হয়ে গেছি! তো কি! ভয়টা ভিন্নরূপে এসে দাঁড়ায়!
এতিমখানা পড়া একেকটা কিশোর লাইফের সাথে যুদ্ধ করেই টিকে থাকে কিংবা পড়ে থাকে সেখানে! যেখানে হয়তো নেই তাদের বাবা কিংবা মা!
মাঝে মাঝে হাফেজী মাদরাসার পাশ দিয়ে গেলে তাদের আওয়াজ শুনতে পাই! কুরআনের ধ্বনি!মাঝে মাঝে যখন দেখি মা দাঁড়িয়ে তার ছোট সন্তানকে বুঝাচ্ছে! তখন শরীরের লোমগুলো ক্রমশ সক্রিয় হয় আর চোখে জল আসে!
হুজুর হুজুর কিংবা খেঁজুর বলে অনেকে যারা টিজ করে তারা এটা ভাবেনা যে তারাও মানুষ! স্বপ্ন,শখ,আহ্লাদ তাদের ও আছে! দিনশেষে আপনার জানাযা টা হয়তো তার মাধ্যমেই হতে পারে!
চলবে!